রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে একদিন: এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্প
ট্রেনের জানালা দিয়ে গড়ানো সবুজ মাঠ আর দূরের বটগাছগুলো যেন আমার দিকে হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। বহুদিন ধরেই শুনেছি—রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নাকি বাংলাদেশে প্রযুক্তি ও অগ্রগতির এক নতুন প্রতীক। বৈজ্ঞানিক কল্পনার বইয়ে যত বিস্ময়ের কথা পড়েছি, সেসব বাস্তবে দেখা যাবে—এমন ভাবনায় মনটা সকাল থেকেই টানটান উত্তেজনায় ভরা।
ইশ্বরদী পৌঁছাতেই প্রথম যে জিনিসটা নজরে পড়ল, তা হলো রাস্তার পাশে বিশাল সাইনবোর্ড—“Rooppur Nuclear Power Plant Project”। অপরিচিত হলেও নামটা দীর্ঘদিনের পরিচয়ের মতো মনে হলো। গাড়ি থেকে নামতেই মুখে এসে লাগল নদীভরা এলাকার হালকা বাতাস। দূরে চোখে পড়ল উঁচু কাঠামোর মতো স্থাপনা—যেন কোনো বিশাল বিজ্ঞানকেন্দ্রের প্রবেশদ্বার।
প্রথম নিরাপত্তা চেকপোস্ট পেরোতেই বুঝলাম, এটি কোনো সাধারণ স্থান নয়। চারদিক নিস্তব্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ, আর অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। একজন গাইড আমাদের নিয়ে গেল ভেতরে। গাইডের চোখেমুখে গর্বের আলো, “আপনারা এখন এমন একটি স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, যা একদিন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠবে।” কথা শুনে বুকটা গর্বে ভরে উঠল।
ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম বিশাল রিঅ্যাক্টর ভবনের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। নির্মাণকর্মীদের যান্ত্রিক আওয়াজ, ক্রেনের উঁচুতে ওঠানামা, আর বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের টিম দেখেই বোঝা গেল—এ প্রকল্পের পরিধি কত বড়। যেন কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সেটে দাঁড়িয়ে আছি।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কন্ট্রোল মডেল রুম। সেখানে ছোট্ট একটি ডিসপ্লে বোর্ডে রিঅ্যাক্টর কিভাবে কাজ করবে, কীভাবে তাপ উৎপন্ন হবে, কীভাবে তা টারবাইনে ঘুরে বিদ্যুতে রূপান্তরিত হবে—সবকিছু সহজ ভাষায় দেখানো হলো। আমার পাশে থাকা এক ছাত্র আবেগে বলল, “ভাই, আমাদের দেশেও এমন প্রযুক্তি! বিশ্বাসই হয় না।” আমি চুপ করে থাকলেও মনে মনে একই অনুভূতি।
এরপর আমরা গেলাম নদীর পাড়ে। পদ্মা যেন নীরবে পুরো প্রকল্পটির দিকে তাকিয়ে আছে—দীর্ঘশ্বাসের মতো বাতাসের শব্দ আর নীরব শীতল জলের ঢেউ। মনে হলো, নদীও যেন জানে—এই কেন্দ্রে একদিন আলো জ্বলবে লাখো ঘরে।
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল যখন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রিঅ্যাক্টরের বিশাল গম্বুজাকৃতির ভবনের সামনে। দূর থেকে মনে হলো, যেন অন্য গ্রহের কোনো স্থাপনা। বাইরে হেলমেট আর সেফটি জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকৌশলীদের দেখে মনে হলো—এরা আমাদের সময়ের নায়ক। বিজ্ঞানকে হাতের মুঠোয় আনা মানুষের শক্তি দেখে মুগ্ধ হলাম।
শেষ মুহূর্তে যখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছিল, গম্বুজটির গায়ে পড়া আলোর রেখা দেখে আমার মনে হলো—এ আলো শুধু সূর্যের নয়, এটা ভবিষ্যতের আলো। সেই আলোয় ভিজে ভিজে আমি বুঝলাম, বাংলাদেশ শুধু স্বপ্ন দেখছে না, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।
ফিরতি পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে একবার তাকালাম। রূপপুর ছোট হয়ে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হৃদয়ের ভেতর তার বিশালত্ব আরও বড় হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছিল—আজকের দিনটা শুধু একটি কেন্দ্র দেখা নয়; এটি আমার দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রার জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠার দিন।





Comments
Post a Comment