অতিরিক্ত খাবার: দেহের ভেতরের অদৃশ্য ‘চাপের কারখানা’—এড়িয়ে চলতে ডাক্তারদের বৈজ্ঞানিক কারণ
আমরা সাধারণত খাবারকে শুধু “পেট ভরার উপাদান” মনে করি। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের চোখে খাবার আসলে এক ধরনের জৈব-সংকেত—যা দেহকে বলে দেয় কবে শক্তি জমাতে হবে, কবে কোষ মেরামত করতে হবে, আর কবে বিশ্রাম নিতে হবে। অতিরিক্ত খাবার মানে হচ্ছে সেই সংকেতগুলোকে বারবার, অকারণে বাজানো। যেন কারও দরজায় ঘণ্টা দিয়ে রাখা হলো আর সারাদিন ধরে সেটি বাজতেই থাকল—একসময় দরজার ভেতরের মানুষ ক্লান্ত, বিরক্ত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক একইভাবে অতিরিক্ত খাদ্য দেহের প্রতিটি অঙ্গকে অতিরিক্ত কাজের চাপে বিপর্যস্ত করে।
১. ‘মেটাবলিক সিস্টেম’—মানবদেহের নীরব কম্পিউটারে ওভারলোড
আমাদের দেহ প্রতিটি খাবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে—কত ক্যালরি আছে, কোথায় পাঠাতে হবে, কোন কোষ কতটুকু নেবে। এই কাজটি করে মেটাবলিক সিস্টেম। অতিরিক্ত খাবার ঢুকলেই সিস্টেমটি “ওভারলোড” মোডে চলে যায়।
যেমন:
রক্তে গ্লুকোজ প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুত বাড়ে
অগ্ন্যাশয়কে বারবার ইনসুলিন নিঃসরণ করতে হয়
লিভারের ওপর জমা হয় অতিরিক্ত গ্লুকোজকে চর্বিতে রূপান্তরের দায়িত্ব
এটি ঠিক যেন একটি ছোট অফিসে হঠাৎ করে হাজার হাজার চিঠি এসে জমা পড়া—কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এজন্য ডাক্তাররা বলেন, অতিরিক্ত খাবার দীর্ঘমেয়াদে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, ও চর্বিযুক্ত লিভার তৈরি করে।
২. অতিরিক্ত খাবার কোষের ‘মেরামতি’ বন্ধ করে দেয়
আমরা ঘুমালে যেমন শরীর বিশ্রাম নেয়, ঠিক তেমনি খাওয়ার বিরতিতে কোষগুলো নিজেকে মেরামত করে। এই মেরামতির প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন সেলুলার অটোফ্যাজি।
কিন্তু যখন আমরা দিনে বারবার, প্রয়োজন ছাড়াই খাই, তখন অটোফ্যাজি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দেহকে বলা হয়—
“মেরামতির সময় নেই, এখন আবার খাবার ভাঙতে হবে।”
ফলে—
ক্ষতিগ্রস্ত কোষ জমে থাকে
কোষে বর্জ্য উপাদান বাড়ে
ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে
বয়স দ্রুত বাড়তে থাকে
ডাক্তারদের মতে, খাবারের বিরতি যত বেশি হবে, তত কোষ মেরামতি বেশি—এই কারণেই আধুনিক গবেষণায় “প্রয়োজনের বেশি না খাওয়া” এখন এক ধরনের বৈজ্ঞানিক লাইফস্টাইল থেরাপি।
৩. পাকস্থলী ও অন্ত্রে অতিরিক্ত খাবারের ‘চাপ প্রবাহ’
অতিরিক্ত খাবার মানে আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাজ করানো, যেটাকে ডাক্তাররা বলেন ডাইজেস্টিভ স্ট্রেস।
এই অবস্থায়—
পাকস্থলী তার স্বাভাবিক অ্যাসিড ভারসাম্য হারায়
গ্যাস, অ্যাসিডিটি, পেট ফাঁপা প্রতিদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়
অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়
খাবার ভাঙার এনজাইমগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না
অন্ত্রের ভেতরে আমাদের “মাইক্রোবায়োম”—যা ৪০ ট্রিলিয়ন ভালো ব্যাকটেরিয়ার একটি জগৎ—অতিরিক্ত খাবারের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
যেন আপনি প্রতিদিন ঘরে এমন অতিথি আনছেন যারা দরকার নেই; ফলে ঘরের লোকেরা তাদের নিয়মিত কাজই করতে পারে না।
৪. অতিরিক্ত খাবার শরীরকে মনে করায়—‘সংগ্রহ করো, জমাও, ফ্যাট বানাও’
মানবদেহের বিবর্তন বলছে:
মানুষ কখনো কখনো খাবারের অভাবে বাঁচতে হয়েছে। তাই শরীর এখনো মনে করে খাবার মানে হলো—
“দুর্ভিক্ষ আসতে পারে, তাই সংগ্রহ করো।”
যখন আমরা অকারণে বেশি খাই, শরীর তা বুঝে নেয় “সংগ্রহের সময় এসেছে” এবং তখন,
চর্বি কোষ ফুলে ওঠে
নতুন চর্বি কোষ তৈরি হয়
বিপাকের গতি কমে যায়
শরীর শক্তিকে পোড়াতে চায় না, জমাতে চায়
এজন্যই অতিরিক্ত খাবারে ওজন দ্রুত বাড়ে, কিন্তু কমাতে কষ্ট হয়।
৫. মস্তিষ্কের ক্ষুধা-সংকেত বিভ্রান্ত হয়ে যায়
খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে দু’টি হরমোন—
গ্রেলিন (ক্ষুধা হরমোন)
লেপটিন (পেটভরা সংকেত)
অতিরিক্ত খাবার লেপটিন রিসেপ্টরগুলোকে অসাড় করে দেয়, ফলে
“পেট ভরলে বোঝা যায় না”
এবং মস্তিষ্ক ভুল তথ্য পায়।
এই অবস্থাকে মেডিকেল ভাষায় বলা হয়—লেপটিন রেজিস্ট্যান্স।
এর ফলে-
সবসময় ক্ষুধা লাগে
রাতেও খেতে ইচ্ছে হয়
মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্র (রিওয়ার্ড সিস্টেম) খাবারে আসক্ত হয়ে যায়
এটা ঠিক যেন মিউজিক সিস্টেম এত জোরে বাজানো হচ্ছে যে আসল সুরটাই ধরা যাচ্ছে না।
উপসংহার
ডাক্তারদের মতে অতিরিক্ত খাবার এড়িয়ে চলা শুধু পেটের সুবিধা নয়—এটি দেহের প্রতিটি অঙ্গ, কোষ, হরমোন, এমনকি মস্তিষ্কের সুরক্ষা। খাবার আমাদের শক্তি, কিন্তু অতিরিক্ত খাবার দেহের ভেতরের “চাপ কারখানা” তৈরি করে, যা নীরবে কিন্তু ধীরে ধীরে বড় রোগের ভিত্তি গড়ে তোলে।
সুতরাং খাবার হোক প্রয়োজন অনুযায়ী—
যতটা দরকার, ঠিক ততটাই।
কারণ কম খাবার দেহকে বঞ্চিত করে, কিন্তু অতিরিক্ত খাবার তাকে ভেঙে ফেলে।

Comments
Post a Comment